
১ ফেব্রুয়ারি সোমবারের বাজেট যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। করোনা অতিমারীর প্রভাবে দেশ তথা বিশ্ব অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে বাজেট কোন দিশা দেখাবে, তা নিয়ে উৎসুক ছিল সব মহল। বাজেট পেশের পর স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান সরকার এবং বিরোধী দলগুলির বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
করোনা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বারের বাজেটে বেশ খানিকটা অর্থ বরাদ্দ করা হল স্বাস্থ্য খাতে। কোভিড পরিস্থিতির মোকাবিলায় GDP ১৩ শতাংশ খরচের কথা ঘোষণার সঙ্গে করোনার ভ্যাকসিন তৈরি ও রিসার্চ ক্ষেত্রে ৩৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করলেন নির্মলা সীতারমন। চলতি বাজেটে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিশেষ জোর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যে আমাদের পরিকাঠামো আরও বড় হয়েছে। এবছর তিনটি বিষয়ের উপর সরকার জোর দেবে। এক, চিকিৎসা, দুই পুষ্টি ও তিন ভ্যাকসিন।’ প্রতিটি বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা ফান্ড বরাদ্দ করেছেন তিনি। চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৫৪ হাজার কোটি টাকা। আগামী ৬ বছরের এই টাকা ব্যবহার করা হবে। এই টাকায় জাতীয় স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলির পরিকাঠামো আরও উন্নত করা হবে। নতুন ১৭টি পাবলিক হেলথ ইউনিট ও ইমার্জেন্সি ইউনিট তৈরি করা হবে। পরিষ্কার জল ও দূষণমুক্ত আবহাওয়ার দিকে নজর দিতে ২.৮৭ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হল। যাতে যেসব জায়গায় মানুষ পরিষ্কার খাবার জল পান না, সেখানে উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করা যায়। স্বচ্ছ ভারত-প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ১ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা।’ বাজেট পেশ হওয়ার পর সেনসেক্স এ বিপুল গতি।
উল্লেখ্য, এবারের বাজেটে যে পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা ভোট একটা গুরুত্ব পেয়েছে, তা বোঝা গেল। ‘নজিরবিহীন’ বাজেটের শুরুতেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্ধৃত করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বাস এমনই পাখি যা ভোর যখন অন্ধকার, তখনও আলো অনুভব করে।’ এছাড়াও বাজেট বক্তৃতার শুরুতেই পশ্চিমবঙ্গে ৬৭৫ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণের ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী সীতারমন। পশ্চিমবঙ্গে সড়ক সংস্কারের জন্য ২৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ৬৭৫ কিলোমিটার অর্থনৈতিক করিডর তৈরি করা হবে। একইসঙ্গে কলকাতা-শিলিগুড়ি সড়কের উন্নয়ন করা হবে। রেলের বাজেটেও ‘উপহার’ পেল বাংলা। খড়্গপুর থেকে বিজয়ওয়াড়া পর্যন্ত ইস্ট-কোস্ট ফ্রেট করিডর নির্মাণ করা হবে। ইস্ট-ওয়েস্ট ফ্রেট করিডরে যুক্ত থাকবে খড়্গপুর এবং ডানকুনি। একইসঙ্গে ইস্টার্ন ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডরের গোমো-ডানকুনি শাখা নিয়ে প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। অসম এবং পশ্চিমবঙ্গের চা-শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য ১,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হতে পারে। জোর দেওয়া হবে মহিলা এবং শিশুদের উপর। তবে বাজেটে কলকাতা মেট্রোর কোনও প্রকল্পে কোনও বরাদ্দের ঘোষণা করা হয়নি। কোচি, নাগপুর, চেন্নাই মেট্রোর জন্য যদিও বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়েছে।
২০২১-২২ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে ৪.৭৮ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ করল কেন্দ্রীয় সরকার। গত বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ করা হয়েছিল ৪.৭১ লাখ কোটি টাকা। এ বছরের বরাদ্দের মধ্যে ২.১২ লাখকোটি টাকা ধরা হয়েছে রাজস্ব খাতে খরচের জন্য এবং ১.১৫ লাখকোটি টাকা ধরা হয়েছে প্রতিরক্ষা কর্মীদের পেনশন খাতে।
সোমবার বাজেট বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা, শুধুমাত্র পেনশন ও গচ্ছিত আমানত থেকে প্রাপ্ত সুদের উপর নির্ভরশীল ৭৫ বছর ও তার ঊর্ধ্বের প্রৌঢ়-প্রৌঢ়াদের আর আয়কর রিটার্ন জমা করতে হবে না। এমনকী শেয়ার ডিভিডেন্ড থেকেও কোনও TDS কাটা হবে না। প্রবীণদের জন্য তৈরি সরকারি স্কিম ‘প্রধানমন্ত্রী বয়া বন্দনা যোজনা’ (Pradhan Mantri Vaya Vandana Yojana)-এ বিনিয়োগের সময় আরও বাড়িয়ে ২৩ মার্চ ২০২৩ সাল করা হল। একইসঙ্গে বাড়ানো হল বিনিয়োগের সীমাও। ওই প্রকল্পে সর্বাধিক ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যায়।’ তবে বেতনভোগী মানুষদের জন্য কোনও আশার আলোই দেখাতে পারল না এদিনের বাজেট। আমজনতার জন্য অপরিবর্তিতই রইল কর কাঠামো। অর্থাৎ এই অর্থবর্ষেও বছরে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত আয় থাকছে করশূন্য।
রাজস্ব আয় বাড়াতে এবার অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়ের উপর ১০০ শতাংশ সেস বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। ফলে বাড়তে চলেছে সব ধরনের মদের দাম। সোমবার বাজেট পেশ করতে গিয়ে এমন সিদ্ধান্তের কথাই ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন।
কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রককে ১০০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হল ভোট পরিচালনার সামগ্রী কেনার জন্য৷ নির্বাচন কমিশন এই টাকায় ব্যালট ইউনিট, কন্ট্রোল ইউনিট ও ‘ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রায়াল ইউনিট’ ওরফে ভিভিপ্যাট (VVPATS) কিনবে৷ এছাড়াও এই টাকা দিয়েই ইভিএমগুলির আনুষাঙ্গিক ব্যয় এবং অচল ভোটিং মেশিন ধ্বংস করাও হবে৷ ভোটারদের সচিত্র পরিচয় পত্রের জন্য কেন্দ্র আলাদা করে আরও ৭ কোটি ২০ লক্ষ টাকা দিয়েছে৷ “অন্যান্য নির্বাচনী ব্যয়”-এর অধীনে আইন মন্ত্রককে ৫৭ কোটি ১০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পৃথকভাবে, নির্বাচন কমিশনকে ২৪৯.১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া করা হয়েছে। শর্ত দেওয়া হয়েছে ব্যয় এবং নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত ভবনের জন্য জমি ক্রয় ও প্রাক-নির্মাণ কার্যক্রমের জন্য এই টাকা ব্যয় করতে হবে। ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার ডিজিটালি জনগণনা করা হতে পারে। ৩,৭৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষানীতির জন্য ১৫,০০০ স্কুলকে শক্তিশালী করা হবে। ১০০ টি নয়া সৈনিক স্কুল করা হবে। ৭৫০ টি একলব্য স্কুল তৈরি করা হবে। লেহ শীঘ্রই তৈরি হবে একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া কৃষি পরিকাঠামো সংক্রান্ত সেসের কারণে কাউকে বেশি টাকা গুনতে হবে না। বায়ুদূষণ কমানোর জন্য বড় সিদ্ধান্ত নিল মোদী সরকার। পুরনো গাড়ি যাতে রাস্তা থেকে সরে যায় তার জন্য ভলান্টারি ভেহিক্যাল স্ক্রেপিং পলিসি নিয়ে এল কেন্দ্র। এর ফলে জ্বালানি বাঁচবে, তেল আমদানির খরচা কমবে ও বায়ুদূষণ কমবেও। পরিযায়ী শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক-সহ অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের জন্য পোর্টাল তৈরি করা হচ্ছে। ন্যূনতম বেতন নিশ্চিত করা হবে। মহিলাদের কাজ করতে হবে। পর্যাপ্ত সুরক্ষা-সহ রাতেও মহিলারা কাজ করতে পারবেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে ২০,০০০ কোটি টাকা ঢালা হবে। চলতি বছরে এলআইসিতে আইপিও শুরু করা হচ্ছে। আগামী অর্থবর্ষে বিলগ্নিকরণের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে ১.৭৫ লাখ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় বাজেটে রেলের জন্য বরাদ্দ করা হল ১১০,০৫৫ কোটি টাকা। যা রেকর্ড বলে দাবি করলেন নির্মলা সীতারামন। গড়ে তোলা হচ্ছে ফ্রেট করিডর। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের ১০০ শতাংশ ব্রডগেজ লাইনের বৈদ্যুতিকরণের কাজ শেষ হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন সীতারামন। ২০৩০ সালের মধ্যে ভবিষ্যতের জন্য রেলের কাঠামো তৈরির জন্য ‘জাতীয় রেল পরিকল্পনা’ হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এই বাজেটকে যথেষ্ট প্রশংসা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছেন, এই বাজেট আত্মনির্ভরতার ক্ষেত্রে দিশা দেখাবে। এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘২০২১-২২ অর্থবর্ষের বাজেট এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে পেশ করা হয়েছে। আজকের বাজেট ভারতকে আরও আত্মনির্ভর করবে’।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র দশকের প্রথম কেন্দ্রীয় বাজেটকে ‘দিশাহীন এবং বিভ্রান্ত’ বলে কটাক্ষ করলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটকে ‘ভেকধারী সরকারের ফেকধারী বাজেট’ বলে কটাক্ষ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তিনি বলেন, ‘রাজ্যের রাস্তা আমরাই তৈরী করে নেবো। বাংলা কী হ্যাংলা? লজ্জা করে না বাংলাকে ছোট করতে?’ জনতার উদ্দেশে মমতার দাবি, ‘এই সরকার সব বিক্রি করে দিচ্ছে। মমতার কটাক্ষ, ‘মিথ্যা দাবির বাজেট। ভারতের প্রথম পেপারলেস বাজেটের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বেসরকারিকরণ, এই বাজেটে দেশের মানুষের ক্ষতি।’